সন্ধ্যে সাতটার ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। বেলা শেষের লালচে আলোয় বহু বহুদূরে একটা চলন্ত বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে ট্রেনটাকে। সেদিকে ছলছলে চোখে অপলক তাকিয়ে আছে তরুণীটি।
-ওহহ গড! সামান্য ট্রেন মিস করলে কেউ এতটা আপসেট হয়!
বসতে বসতে কথাগুলো কানে গেল মেয়েটা। লোকটা ইচ্ছে করেই কথাগুলো ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে বলে ওর ধারণা। দুহাতের তালুতে ভেজা চোখজোড়া মুছে লোকটা দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শুধু, মুখে কিছু বলল না।
-কোথায় যাবেন?
-জেনে কী করবেন?
-না না, এমনি! মানে ট্রেন ফেল করে যে পরিমাণ আপসেট হয়েছেন তাতে মনে হয়েছে আপনি বুঝি ফ্লাইট মিস করে ফেলেছেন!
মেয়েটা আবারো একটা অগ্নিদৃষ্টি হানলো। ছেলেটি সেটা উপেক্ষা করে নিজের মতো করে কথা চালিয়ে যাচ্ছে
-তবে আমি বোধ হয় সত্যি সত্যিই ফ্লাইট মিস করবো! ফ্লাইট রাত সাড়ে বারটায়, এয়ারপোর্টে যেতে লাগবে প্রায় দু’ ঘন্টা। এখন বাজে সোয়া সাত। জানেন তো পরের ট্রেন…
-জানি, তিন ঘন্টা পর। কষ্ট তো লাগছে সেটা ভেবেই!
স্বগতোক্তির মতো নিচু কণ্ঠে কথাগুলো বলল মেয়েটা। ভোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টি মেলে সামনে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টির প্রান্তসীমায় নজর বুলিয়ে ছেলেটি কথায় ফিরল।
-কিন্তু আপনি তো দূরে কোথাও যাবেন না; লোকাল বাসে গেলেও তো…
-আপনাকে কে বলল আমি দূরে কোথাও যাব না?
-বা রে, আপনার সাথে তো কোনো ভারি ব্যাগ বা লাগেজ টাগেজ কিছু নেই। মেয়েরা দুদিনের জন্যে দূরে কোথাও গেলেও তো…
-আপনার সাথেও কিছু নেই!
-আছে তো! এই যে…
ছেলেটা ওয়ালেট থেকে তিন পাতার একটা ডকুমেন্ট বের করলো।
-কী এটা?
-এটা? এটা একটা স্পিচ লেটার! বেড়াতে যাচ্ছি না, তাই ব্যাগ ট্যাগ কিছু নাই। যাচ্ছি একটা স্পিচ দিতে। কোলকাতায় একটা কনফারেন্স আছে। বেলা ন'টায় কনফারেন্স; স্পিচ দিয়ে কালকের ফ্লাইটেই আবার চলে আসব। সাইকোলজির প্রফেসর কিনা!
-আপনি প্রফেসর! মিথ্যে বলছেন কেন? আপনি বড়জোর স্টুডেন্ট হতে পারেন!
-হ্যাঁ হ্যাঁ, স্টুডেন্টই তো!
-তাহলে প্রফেসর কেন বললেন?
-আমি তো প্রফেসরই! মনে মনে! মানে আমার লক্ষ্য সাইকোলজির প্রফেসর হওয়া। আমার ড্রিম; তবে স্বপ্নটাকেই এত বাস্তব মনে হয় যে পরিচয় দিতে গিয়ে কখনো কখনো প্রফেসর বলে ফেলি আরকি! স্যরি…
মেয়েটি বিরক্তিভরে ছেলেটার দিকে একবার তাকালো শুধু, মুখে কিছু বলল না।
-বাই দ্য ওয়ে, আমার না হয় ড্রিম-জব বলে ‘প্রফেসর’ কথাটা মুখ ফুটে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আপনি কেন মিথ্যে বললেন যে অনেক দূরে যাবেন?
-আমি কখন বললাম দূরে যাব?
-বলেন নি? হুম! ওহ, তাহলে বোধ হয় গেস করেছি!
-কেন গেস করেছেন?
-ওই যে, চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন…!
-সবাই কি ট্রেনে চড়তে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করে?
-করে না? তাহলে? আপনি কেন অপেক্ষা করছেন?
মেয়েটা ছেলেটির দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-আচ্ছা আপনি সুইসাইড টুইসাইডের কথা ভাবছেন না তো?!
মেয়েটি ঝট করে ছেলেটির দিকে তাকালো। কিছু বলল না। ছেলেটি আবারো মুখ খুলল
-দেখুন মিস…, আমি সাইকোলজির প্রফেসর না ঠিক, তবে সাইকোলজির ছাত্র। কোলকাতা যাচ্ছি South Asian Psychology Students' Association (SAPSA)'র অ্যানুয়াল কনফারেন্সে স্পিচ দিতে। আমি কিন্তু সাইকোলজির ব্রাইট স্টুডেন্ট, ক্লাস টপার। মানুষের মুখ দেখে বলে দিতে পারি মনের ভিতরে কী চলছে!
-তাই বুঝি! বলুন দেখি কী চলছে আমার মনের ভেতর?
মেয়েটির কণ্ঠে জেদের সুর। ছেলেটি তার দিকে সরু চোখে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন চোখের দৃষ্টিতে মেয়েটির মনের গলিঘুঁজি ঘুরে দেখছে।
-আপনার মনে অনেক কষ্ট! সম্ভবত খুব কাছের একজন সম্প্রতি আপনাকে ছেড়ে গেছে। বয়ফ্রেন্ড?
-হুম!
মেয়েটি খুব ধীরে বলল।
-মারা গেছে, না ব্রেক-আপ? মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই…
-মারা গেছে! কিন্তু আপনি কীভাবে বুঝলেন বয়ফ্রেন্ড? এবং সে মারা গেছে?
-খুব সোজা! দেখুন, বাবা মা বা রক্তের সম্পর্কের কেউ মারা গেলে আমরা কষ্ট পাই, ভীষণ কষ্ট পাই। কিন্তু সেজন্যে জীবন দিতে ছাদে যাই না বা রেললাইনে আসি না। জন্মসূত্রে পাওয়া কিনা! কিন্তু বিএফ জিএফ ছ্যাঁকা দিলে হাতের রগ কাটি! তবে সেটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আপনি রগ কাটেন নি, মানে ‘ছ্যাঁকা কেস’ না! সাদা কিংবা কালো ড্রেসে না, অতএব শোকসভা থেকে সদ্য ফিরেছেন, এমনটাও না। চোখের নিচে কালো দাগ- তার মানে অনেক দিন ধরে ভালো ঘুম হচ্ছে না। চেহারা শুকনো, মানে খাওয়া-দাওয়ায় অবহেলা আছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে অন্তত মাস খানেক হবে আপনার প্রিয়তম গত হয়েছে। মিলেছে?
-হুম, অনেকটা! তবে ও মারা গেছে তিন মাস হলো…
-তিইইইন মাস! এতদিনেও শোক ভুলতে পারেন নি!
মেয়েটি কিছু বলল না, নিচের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-দেখুন, আপনার কষ্টকে ছোট করে দেখছি না; প্রতিটি প্রিয়বিচ্ছেদই কষ্টের। কিন্তু জীবনের আর দশটা ঘটনার মতো এটাও জাস্ট একটি ঘটনা। বড় ঘটনা, তবে ঘটনা-ই তো! এর জন্যে জীবন দিতে হবে? আপনার বাবা মা আছে, তাদের কথা ভাবুন…
-নেই!
-জ্বি?
-বাবা মা কেউ নেই!
-ওহহ স্যরি!
-ওর চলে যাওয়া জাস্ট একটা ঘটনা না। একটা স্বপ্নের মৃত্যু! আমার জীবন-দুর্দশা শেষ হওয়ার স্বপ্নের মৃত্যু…
মেয়েটা অসহিষ্ণুভাবে চিকন গলায় কথাগুলো বলল। বলতে বলতে গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো।
-আ’ম সো স্যরি…। বাট, কী সেই স্বপ্ন? কেন এত কষ্ট?
-আপনাকে কেন বলব? হু আর ইউ?
-মি? টু ইন্ট্রোডিউস- আই মাইসেলফ রায়চাঁদ, সান অফ কালাচাঁদ…. হা হা হা!
মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকাল
-স্যরি… স্যরি ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ! মজা করছিলাম। ওকে, আই এম নোবডি! তারপরও বলতে পারেন; হালকা লাগবে…
-আমি হালকা হতে চাই না!
-আচ্ছা অসুবিধা নেই, আপনি কিছু একটু বলুন। আমি শুনি, শুনে আরো কিছু দুঃখের কথা অ্যাড করে আপনাকে আরেকটু ভারি করে দেই, হা হা হা…!
মেয়েটির চেহারা বিষণ্ণ হয়ে গেল। কেউ অন্যের কষ্টে উপহাস করতে পারে এভাবে!
-স্যরি, আপনাকে দুঃখ দেয়ার জন্যে রিয়েলি স্যরি। দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না, আপনিও আমাকে চেনেন না। এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে চুপচাপ বসে আছি দুজন। হাতে সময় আছে আরো প্রায় দু’ ঘন্টা। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা আমার জন্যে কঠিন। তাছাড়া আর দু’ঘন্টা বাদে আপনি ওপারে চলে যাবেন… চারিদিক থেকে সহস্র মানুষ ছুটে আসবে আপনার ছিন্নভিন্ন লাশের দিকে; কেউ জানতেও পারবে না আপনার মনের কথাগুলো। একবার ভাবুন তো, আপনার পরিবারে আপন বলতে কেউ নেই, কেউ জানে না আপনার মনে কী ভীষণ যন্ত্রণা। এ কেমন কথা? জগতের একটা প্রাণী অন্তত জানুক!
-কী হবে একটা প্রাণী জানলে?
-ধরুন… আচ্ছা, আমি কিন্তু একজন লেখকও। সামনের বইমেলায় পাঁচটা বই লেখার ফরমায়েশ আছে। কিন্তু এত স্টোরি কোথায় পাব বলুন! হাতে আছে মোটে দুই মাস; যদি আপনার জীবন থেকে কিছু লিখতে পারি…
-আরেকজনের কষ্টের কথা লিখে অর্থ উপার্জন… বাহ চমৎকার!
-ছি ছি এভাবে ভাবছেন কেন? আপনার কষ্টের কথা জেনে আরেকজন যদি অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়…
-অন্যের স্রেফ কষ্টের ভেতর অনুপ্রেরণা খোঁজার কিছু নেই; কেউ অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে যদি সেই ব্যক্তি তার কষ্ট জয় করতে পারে।
-দারুণ একটা কথা বলেছেন তো!
“কষ্টের ভেতরে না, অনুপ্রেরণা আছে কষ্টজয়ের ভেতর”
ছেলেটি আনতমস্তকে অস্ফুট স্বরে কয়েকবার আওড়ালো কথাগুলো। হঠাৎ একটা কথা মাথায় খেলে গেল। সটান মুখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল-
-এত সুন্দর বিশ্লেষণ আপনার, কিন্তু আপনি কেন কষ্ট জয় করতে পারছেন না?
মেয়েটি ক্লান্ত চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল, তাকিয়েই রইল। অনেক্ষণ বাদে কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরুলো অজস্র যন্ত্রণার প্লাবন।
-যখন টনকে টন কয়লা ঘেঁটে এক টুকরো হীরে পাওয়ার পর সেটা হারিয়ে যায়- কেমন লাগে তখন? যখন আনন্দের স্মৃতিগুলো সারাটা দিনরাত তাড়িয়ে ফেরে হিংস্র শ্বাপদের মতো, যখন ১০ মিলিগ্রামের স্লিপিং পিল খেয়েও একটু শান্তির ঘুম হয় না, কেমন লাগে তখন? যখন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রতিটা ভিজিটে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে চলে, যখন সবচেয়ে প্রিয় খাবারটাও বিস্বাদ লাগে, যখন সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটার সাথেও কথা বলতে ভালো লাগে না, যখন সবচেয়ে প্রিয় সিনেমাটাও বোরিং লাগে, যখন সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, রেজাল্ট খারাপ হলে বছর নষ্ট হবে জেনেও সারাটা জীবন ফার্স্ট মেয়েটিরই বইয়ের পাতা উলটে দেখতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না- কেমন লাগে তখন?
-হুম, খুব খারাপ লাগারই কথা! কিন্তু আপনি যে বলছেন সারাটা জীবন আপনার দুঃখ কষ্টে জর্জরিত- আসলেই কী তাই?
-আমার কোনো শৈশব-আনন্দের স্মৃতি নেই। বোঝার বয়স হওয়ার পর জানলাম মা আমাকে ফেলে আরেকজনের সাথে চলে গেছে। বাবাও আমাকে একা রেখে ওপারে চলে গেল যখন আমার বয়স সাত। খালা সাথে নিয়ে নিলেন। খালা আদর করতেন খুব। কিন্তু দুবছরের মাথায় পাঠিয়ে দিলেন এতিমখানায়। খালুর কুদৃষ্টি পড়েছিল ছোট্ট এই আমার ওপর। এতিমখানায় কীভাবে একেকটা দিন কেটেছে তা আমি জানি আর জানেন এক আল্লাহ্।
মেয়েটি থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খানিক নীরবতা। একটু পরে শান্ত কণ্ঠে ছেলেটা বলল
-দেখুন, আপনার প্রতি আমি সিম্প্যাথি বোধ করছি। সত্যিই খুব স্ট্রাগলিং লাইফ আপনার। কিন্তু একটা কথা কি জানেন- জীবনে দুঃখের মুখোমুখি সবাইকেই হতে হয়, হতে হবেই- এ এক অমোঘ নিয়তি! আপনার সৌভাগ্য যে অল্প বয়সেই আপনি সেগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। আর এতটা কঠিন পথ একা পেরিয়েছেন বলেই আপনার ‘পা’ জোড়া শক্ত হয়েছে। ভেবে দেখুন, বাপের টাকায় মাস্তি করা আপনার বয়সী কত ছেলেমেয়ে অকালে ঝরে পড়েছে; আপনার বয়সে পৌঁছার আগেই বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছে কত মেয়ে। অথচ আপনি নিজের যোগ্যতায় এই পর্যায়ে এসেছেন। রুয়েটের মত নামকরা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রিপল-ই’র মতো সাবজেক্টে…
এটুকু বলেই জিভ কাটল ছেলেটা। আবেগের বশে বলতে বলতে এমন একটা কথা বলে ফেলেছে যেটা বলা উচিৎ হয় নি। মেয়েটা কিন্তু ধরে ফেলেছে! চোখ সরু করে ছেলেটার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো-
-আমি আপনাকে কখনো বলি নি আমি রুয়েটে ট্রিপল-ই’তে পড়ি! কোনো সাইকোলজিস্ট স্রেফ চেহারা দেখে এতটা সঠিকভাবে বলতে পারবে না। কিন্তু আপনি পেরেছেন! তার মানে আপনি এটা আগেই জানতেন। আমার সম্পর্কে একটু আগে আরো যা যা বলেছেন সেগুলোও অনুমান করে বলেন নি, জেনেশুনেই বলেছেন! সত্যি করে বলুন তো আপনি কে? আমাকে কেন ফলো করছেন?
ছেলেটি বুঝলো ধরা পড়ে গেছে! এবার আর কথা ঘোরানোর সুযোগ নেই। সত্যটা এবার বলতেই হবে।
-আমার নাম জীবন, সৈয়দ জীবন হোসেন। আপনার প্রোফাইলটা রুমি আমাকে দিয়েছে।
-রুমি? মানে আমার ক্লাসমেট রুমি?
-হ্যাঁ!
-আমার প্রোফাইল মানে?
জীবন ওয়ালেট থেকে তিন পাতার কাগজটা বের করে লিনুকে দেখালো। কোনো কনফারেন্সের স্পিচ না এটা; এতে আছে লিনুর ছবিসহ পরিচয়-পরিচিতি এবং জীবনের কিছু ঘটনা। লিনু অবিশ্বাসভরা চোখে জীবনের দিকে তাকালো।
-আই কান্ট বিলিভ দিস! রুমি এগুলো আপনাকে দিয়েছে?
-হুম!
-হোয়াই? হু আর ইউ?
-নাম তো আগেই বলেছি। ধাম কুষ্টিয়া। আর চালাই একটি অলাভজনক সংস্থা। এই শহরেই; নাম ‘সুইসাইড প্রিভেনশন এন্ড প্রো-লাইফ ট্রিটমেন্ট সেন্টার’! এটার কাজ হলো…
-থাক আর বলতে হবে না! যারা সুইসাইড করতে চায় তাদের পিছু নেয়া আর বুঝিয়ে শুনিয়ে জীবনে ফিরিয়ে আনা- এই তো?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই!
-তো… আমি আপনাদের কততম ‘গিনিপিগ’?!
-ছি ছি, এভাবে কেন বলছেন! দেখুন পৃথিবীটা রঙিন, কিন্তু আপনি ঘোলাটে চশমা দিয়ে দেখছেন বলেই এটা এমন ম্যাড়ম্যাড়ে, বর্ণহীন লাগছে। জীবনটা আসলে অনেক সুন্দর, যদি…
-থাক, আর সিনেমার ডায়লগ দিতে হবে না! বেশ তো স্যুটেড-ব্যুটেড হাল ফ্যাশনের মানুষ! বাবা নিশ্চয়ই কোটিপতি?
লিনু শ্লেষের স্বরে বলল।
-জী…?
-বাবা পয়সাওয়ালা, পুত্রের বেগার খাটতে হয় না। তাই নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানোর চাকুরি নিয়েছেন! প্রাসাদের চূড়ায় বসে তলার মানুষগুলোর জীবন কতটাই বা বুঝবেন! এসেছেন আরেকজনের কষ্ট জয় করতে…
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল লিনু। রাগে বিরক্তিকে চোখমুখ কুঁচকে আছে ওর।
-দেখুন, আপনি ভুল বুঝছেন! আমি…
-অনেক হয়েছে, আর কিছু শুনতে চাই না। আপনার সাথে কথা বলেই ভুল হয়েছে। কী বোকা আমি, টেরই পেলাম না এতক্ষণ একটা প্রতারকের পাশে বসে আছি!
কথাগুলো বলেই লিনু উঠে যাচ্ছিল। জীবন এতক্ষণ শান্তভাবে ওর কথা শুনছিল। এবারে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল ওর।
-দাঁড়ান, এভাবে আপনি চলে যেতে পারেন না মিস লিনু!
-এন্ড হোয়াই মি. জীবন?
-কারণ আমার কাছে আপনার একটা ঋণ আছে!
-হোয়াট! ঋণ মানে?
-কথার ঋণ! আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে আপনি ঋণী হয়ে গেছেন। এখন আমি আপনাকে সুদে-আসলে ঋণ শোধ করব… হা হা হা…
সিরিয়াস ভঙ্গি থেকে হুট করেই হাসিতে ফেটে পড়ল জীবন। লিনু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমন বিচিত্র মানুষ ও জীবনেও দেখে নি।
-স্যরি, আবারো ফান করলাম। স্যরি অ্যাগেইন। আমি তখন আপনাকে বলেছিলাম না, আপনার দুঃখের কথা শুনে যদি কম মনে হয় তাহলে আমি কিছু দুঃখ দিয়ে ফিল-আপ করে দেব; ওটাই এখন করব! সব শোনার পর বিবেচনা করবেন দুনিয়াতে আপনার দুঃখই সবচেয়ে বেশি, নাকি এরচেয়েও দুঃখ থাকা সম্ভব। এরপরও যদি নিজের দুঃখ বেশি মনে হয় তাহলে ঘন্টা দেড়েক বাদে অপশন তো আপনার হাতেই আছে! আমি আপনাকে বাধা দেব না।
জীবন খুব কনফিডেন্টলি বলল কথাগুলো। লিনু ওর প্রস্তাব ফেলতে পারল না। চুপচাপ সিটে বসল।
-আমার জন্ম কুষ্টিয়ার থানাপাড়ায়। খুব সুন্দর জায়গা, গেছেন কখনো ওদিকে?
-হু? ও, না!
-মিস করেছেন! তো যা বলছিলাম- গড়াই নদীর তীরে বাঁধের ধারে সুন্দর খেলার জায়গা। শৈশবে ওখানেই হেসেখেলে বেড়িয়েছি। দুপুরে বড় ভাই আর বন্ধুদের সাথে নদীতে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম। আর এতটা সময় বাইরে থাকার কারণে প্রতিদিনই মায়ের বকা খেতাম।
একদিন গোসল শেষে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। উঠোনের একপাশে রান্নাঘর; ভেতরবাড়ি কে ঢুকছে তা রান্নাঘর থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া মুশকিল!
উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকছি; শাসন করার জন্য মা আজ আর ছুটে এলো না অন্যান্য দিনের মতো। ঘরের ভেতর মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। কোথাও মা নেই! এ-ঘর ও-ঘর করে শোবার ঘরে এসে দেখি বাবা বিছানায় বসে আছে। নির্বাক। ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলাম মা মেঝেতে শুয়ে আছে। মেঝে ভেসে যাচ্ছে মায়ের তাজা রক্তে। রক্তমাখা দাঁ কোলে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বসে আছে বাবা।
বিকেল হওয়ার আগেই পুলিশ এসে বাবাকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে গেল। ঠান্ডা মাথার খুন! মামারা আরোপ করল বাবা যৌতুকের দাবিতে খুন করেছে; চাচারা বলল মায়ের পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। কারণ যা-ই হোক, খুন তো খুন-ই! স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বাবার ফাঁসির রায় হল।
বাবা নাকি একবারের জন্যেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন নি। ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপীল আবেদনও করেন নি।
আমাদের সাজানো সংসারটা মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পুরোপুরি এতিম হয়ে গেলাম আমরা। আমাদের চার ভাই-বোনের জায়গা হলো মামাদের সংসারে।
ছোট কেউ ভুল করলে মানুষ গালি দেয় ‘অমুকের বাচ্চা’ ‘তমুকের বাচ্চা’, আমাদের গালি দিত ‘খুনীর বাচ্চা’! খুনীর বাচ্চার তকমা নিয়ে বড় হয়েছি আমি।
একা আমি কেন? কারণ কৈশোর পেরোনের আগেই ভাই-বোনদের হারিয়েছি।
ছোট ভাইটা অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেল বয়স যখন চার। আমাদের দেখেশুনে রাখত বড় ভাই। পড়ালেখা চালিয়েছি ভাইজানের মেহনতের টাকা আর অনুপ্রেরণায়। গাড়ির হেলপার ছিল, হেল্পার থেকে ড্রাইভার। একটা এক্সিডেন্টে সেও মারা গেল।
ভাইদের সবার আদরের ছিল যে বোনটা, গলায় ফাঁস নিল যখন ও ক্লাস নাইনে। এলাকার এক রাজনৈতিক নেতার বখাটে ছেলের কুদৃষ্টিতে পড়ে গেছিল বোন আমার। সব হারিয়ে যখন থানায় গেল, পুলিশ এফআইআর তো নিলই না, উল্টো নির্লজ্জ নির্মম হাসিঠাট্টা শুরু করলো। বোনটা নিতে পারে নি এতসব।
নিতে পারি নি আমিও। ধারালো দাঁ’টা নিয়ে ছুটে গেছিলাম হাটের ভেতর। জানোয়ারটাকে হাতের কাছে পেয়েও গেছিলাম। কিন্তু চৌদ্দ বছরের একটা কিশোর অতগুলোর ষণ্ডার সাথে কি আর পারে! ভরা হাটের মধ্যে চোর অপবাদ দিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পেটালো, জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল। মাথার অর্ধেকটা চুল কামিয়ে চুনকালি লাগিয়ে দিল। সাথে হাসিঠাট্টা উপহাস- ‘খুনির পোলা চোর!’ অতটুকু ছেলেটা শরীরের ব্যথা হয়ত সয়ে নিতে পারত, কিন্তু মনের ব্যথা সইতে পারল না। একছুটে চলে গেল রেলস্টেশনে, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে। তারপর…
একনাগাড়ে অনেক কথা বলে জীবন হঠাতই কেন জানি চুপ মেরে গেল। নীরবতা ভাঙল লিনু।
-তারপর? কী হলো তারপর?
-তারপর? তারপর আর কি, চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলাম!
জীবন আবারো চুপ। লিনু অসহিষ্ণু বোধ করছে, একটু ভয় ভয়ও…
-তারপর…?
-তারপর ট্রেন আমার ওপর দিয়ে চলে গেল। শরীরের হাড়গুলো একটা একটা করে ভেঙে গেল, আমি মরে ভূত হয়ে গেলাম! এখন অতৃপ্ত আত্মার মতো স্টেশনে স্টেশনে ঘুরে সুইসাইডাল মানুষদের মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে বেড়াচ্ছি… হা হা হা…
জীবন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার উপক্রম। পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে লাগল ওর কাণ্ড। লিনু এতক্ষণ সিম্প্যাথি বোধ করলেও এখন মহাত্যক্ত বোধ করছে।
-কী হলো, এভাবে হাসছেন কেন? সবকিছু নিয়ে কি রসিকতা করতেই হবে?
-ওফ, মাআআআ গোওওও, পেট ব্যথা হয়ে গেছে! ওকে, আ’ম স্যরি… স্যরি এগেইন! মোটিভেশনাল স্পিকার তো, রসিকতা মজ্জাগত!
-আপনি কি তাহলে সেদিন ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন নি?
-দিয়েছি তো!
-তাহলে...? আপনার কিছু হলো না যে…?
-কে বলল হয় নি? হয়েছে তো! ঘটনাটার পর আমার চিন্তাধারায় বিশাল একটা পরিবর্তন এলো। প্রথমবার অনুভব করলাম জীবনটা আসলে অনেক সুন্দর। অনেক কিছু হারাবার পরও আসলে অনেক কিছুই রয়ে যায়, সেটুকুও না হারালে বোঝা যায় না- সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। আফসোস, এই বোধটুকু যদি ঝাঁপ দেয়ার আগেই হতো তাহলে…
-তাহলে?
-তাহলে…
জীবন দু’হাতে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গোটালো
-তাহলে নিজের পায়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে পারতাম, কাঠের পা লাগত না!
জীবন থামল। লিনু বিস্ময়ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ভাঙল জীবন।
-শেষ মুহূর্তে পেছন থেকে কেউ একজন টেনে ধরেছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেছি; কিন্তু পা দুটোকে বাঁচানো যায় নি। ট্রেনের চাকা উঠে গেছিল দু'পায়ের ওপর দিয়ে…
আমার লাইফ-ড্রিম সেদিনই শেষ! জাস্ট একটা ভুল ডিসিশনের কারণে। ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হব। ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় সহপাঠীরা লিখত জজ-ব্যারিস্টার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমি সব সময় লিখেছি আর্মি অফিসার হব। স্কুল পেরোনোর আগেই সেই স্বপ্নের সমাধী হয়ে গেল…
এক মাস হাসপাতালে ছিলাম। সুস্থ হওয়ার পর খুব খারাপ লাগত। কিন্তু হঠাৎ একদিন মনে হলো- আচ্ছা, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়ার আগে মনে হচ্ছিল আমার জীবনের সব শেষ হয়ে গেছে; পা কাটা পড়ার পর বুঝলাম তখনো অনেক কিছুই ছিল। তাহলে এখন কেন ভাবছি সব বরবাদ হয়ে গেছে? দুটো হাত তো এখনো আছে, দুটো চোখ তো এখনো আছে! সবচেয়ে বড় কথা ঘাড়ের ওপর অমূল্য সম্পদ আস্ত একটা ব্রেইন আমার আছে। ঠিক করলাম এই দিয়েই আমি দুনিয়া জয় করব…
সেদিনের চিন্তাটা আমার জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দিল। আপনি তখন বলছিলেন না আমি নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াই! হ্যাঁ, বনের মহিষ তো তাড়াই-ই; সেই সাথে নিজের জীবনটাও গড়ে নিয়েছি। SAPSA'র বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমি। সত্যি সত্যিই কোলকাতায় অ্যানুয়াল কনফারেন্সে স্পিচ দেব, তবে নেক্সট উইকে। আর নেক্সট মান্থে দেশ ছাড়ছি নরওয়ের জন্যে, রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ সাইকোলজিতে যোগ দেব রিসার্চ ফেলো হিসেবে। ফুল ফান্ডেড স্কলারশীপ পেয়েছি…
-কিন্তু আপনার লাইফ-ড্রিম তো নষ্ট হয়ে গেছে- এ নিয়ে আক্ষেপ নেই?
-কে বলেছে জীবনে একটা স্বপ্নই দেখতে হবে! একটা স্বপ্ন নষ্ট হলে আরেকটা স্বপ্নের হাত ধরে এগোতে হবে। কোনো অবস্থাতেই স্বপ্নের হাত ছাড়া যাবে না। তাহলে জীবনটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে যে!
-অসাধারণ… মাইন্ডব্লোয়িং… সত্যিই আপ্লুত হলাম আপনার জীবনের গল্প শুনে
-আরেকটা খুব খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও কিন্তু সেদিন আমার হয়েছে-
-কী সেটা?
-মৃত্যু যখন আসবে, ঘরে বিছানায় শুয়েও মরতে হবে। আর মৃত্যু যদি না আসে তাহলে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েও বেঁচে যেতে হবে। তাহলে ওই লাফ-ঝাঁপ দিতে গিয়ে জীবনে কেন দুর্দশা ডেকে আনবেন, বলুন?
জীবনের কথা শেষ হতে না হতেই ট্রেনের হুঁইসেল শোনা গেল। ট্রেন স্টেশন থেকে এখনো খানিক দূরে; তবে রাতের বেলা অল্প শব্দও বহুদূর থেকে শোনা যায়।
-তো… আপনার 'কাঙ্ক্ষিত' ট্রেন তো চলে এলো! কী ঠিক করলেন, কী করবেন? ঘরে ফিরে যাবেন, নাকি....
লিনু ভেজা চোখজোড়া আলতো করে মুছে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রেললাইনের দিকে। জীবন বিস্মিত হলো- এতকিছু শোনার পরও কি মেয়েটা তাহলে…?
লিনু যেন ওর মনের কথা শুনতে পেল। ফিরে এলো ওর দিকে। ভুলে সিটে ফেলে আসা পার্সটা তুলে নিতে নিতে মুচকি হাসলো
-ভয় নেই, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেবো না! ঝাঁপ দেয়ার জন্যে আসিও নি। রাতের এই শেষ ট্রেনে ফিরে যাচ্ছি হোস্টেলে। এখানে এসেছিলাম ডা. নেয়ামত আলীর কাছে। রেগুলার চেক-আপ। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট, চেনেন বোধ হয়! ওনার আন্ডারে আছি তিন মাস হলো। লিওন মারা যাওয়ার পর একদম ভেঙে পড়েছিলাম। সময়ের সাথে সাথে আরো দুমড়েমুচড়ে গেছি। ট্রেন মিস করার মতো সামান্য ব্যর্থতায়ও হতাশ হয়ে পড়ছিলাম।
বাট থ্যাংকস গড, আপনার সাথে দেখা হলো! ডাক্তার তিন মাসেও যা করতে পারে নি আপনি মাত্র তিন ঘন্টায় সেটা করেছেন! এবার আমি ঘুরে দাঁড়াবই। সব শূন্যতাবোধকে ফেলে যাচ্ছি রাতের এই রেলস্ট্রেশনে। একরাশ আশার আলো নিয়ে আমার জীবনে কাল উদিত হবে এক নতুন সূর্য। থ্যাংকস… ফর লাইফ!
স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। লিনু মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেল ট্রেনের দিকে। জীবন তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার পথে।
প্রো-লাইফ ট্রিটমেন্ট সেন্টার চালুর পর জীবন ও তার সহকর্মীরা এখন পর্যন্ত ৩১ জনকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু লিনুর মতো কেস জীবন জীবনেও দেখে নি। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। লিনুকে প্রথম দেখার পর থেকেই। তবে কি…?